উপলব্ধিই যেখানে বাঁধা

জীবন-যাপন প্রচ্ছদ

বিশেষ নিবন্ধ :

লিখতে লিখতে লেখাটি দীর্ঘ হয়ে গেল-তবুও পড়বেন আশা করি। একটি সত্য ঘটনা দিয়েই লেখা শুরু করি।আমাদের ছোট্ট একটি কুকুরছানা ছিল। আমার দুই ছেলে নাম রেখেছিল Tupak.সে আমাদের পরিবারের celebrity হয়ে উঠেছিল। প্রচণ্ড আদরে ভালোবাসার মাঝে বড় হতে থাকলো Tupak.সে সময় আমার হাতের একটা ব্যথার জন্য আমাকে pain killer খেতে হতো।একদিন আমার হাত থেকে অসাবধানতায় পরে যাওয়া pain killer ,Tupak খেয়ে ফেলে।Pain killer,puppy র জন্য বিষাক্ত-আগে তা জানতামই না। একজন Vet এর কথামত আমি অনেক পানি খাওয়াতে থাকলাম -পরে নামকরা একজন Vet এর কাছে নিলে তিনি বললেন, ভুল ভাবে পানি খাওয়ানোর কারণে Tupak এর ফুসফুস পানিতে ভরে গেছে।Tupak এর করুণ চাহনী আমাদের তীরের মত বিদ্ধ করছিল। আমাকে অপরাধী করে Tupak এর ৩ মাসের জীবন শেষ হয়ে গেল।বাঁচাতে গিয়ে কি করলাম আমি!! আপনারা হয়তো বলবেন-একটা কুকুর নিয়ে এত ন্যাকামী। কিন্তু সত্যটি হলো ওর জন্য দিনের পর দিন কেঁদেছি আমরা। আর আমার অপরাধবোধ আমাকে অস্থির করে তুলেছিল- যদি ওষুধ’টা নিয়ে আরো সাবধান হতাম, যদি বার বার পানি না খাওয়াতাম- মনে হচ্ছিল, Tupak এর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। তখন বার বার অপ্রাসঙ্গিক ভাবে প্রাসঙ্গিক এই কথা গুলো মনে পরছিলঃ-।

কোন্দলে, ক্ষমতার লোভে, নিজ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে- মানুষ মানুষকে খুন করে কিভাবে?
রাজনৈতিক দলগুলো- অন্য দলের নেতা কর্মীকে জখম, হত্যা করে কিভাবে? একজন মানুষ হত্যা করে নির্লিপ্ত থাকে কিভাবে? মানুষ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে “job done” বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে কিভাবে? জমির জন্য খুন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন, খুনের বদলে খুন, এমনকি কার গাছ কার জমিতে এসে পরল সেই ঝগড়ার জেরে, টেণ্ডাররবাজির কারণে খুন- মানুষ মারা কি এতই সহজ? অপরাধবোধ জাগে না? হাত কাঁপে না? অনুশোচনা হয় না? নিজের উপর নিজের ঘৃণা হয় না?

রাজনীতি হোক মানবিক। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী-এটা মানার মত সহনশীলতা অন্যের থাকতে হবে । অন্য কেউ- অন্য দল করতেই পারে। তাকে আক্রমণ করা,বাক্য বানে বিদ্ধ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এই মেনে নেয়া থেকে সহনশীলতার culture তৈরী হয়। কেবল যা মানা যাবে না- তা হলো -অন্যায়।

আরেকটি উপলব্ধির কথা লিখি। আমি সব সময় ভেবেছি একজন মন্ত্রীর কাজ হল- দেশ এবং জনগনের উপকার করা। তাই ভেবেছি, সরকারের যে কাজগুলো সরকারী প্রতিষ্ঠানই করতে পারে, সেই কাজ গুলো প্রাইভেট কোম্পানী দিয়ে করালে, তাতে দেশেরই ক্ষতি। আমি প্রাইভেট কোম্পানীর পদ লেহনে বিশ্বাসী নই। তবে যে কাজ তাদের expertise ছাড়া সম্ভব নয়, সেখানে তাদের সহযাত্রী হতে বাঁধা নেই। এই যে লিখছি, সেই লেখারও নানা যন্ত্রণা আছে। মন্ত্রী বা এমপি কিছু লিখলে মানুষ বলবে মন্ত্রী থাকার জন্য কতই না তৈল মর্দন, মন্ত্রী না থাকা অবস্থায় কিছু লিখলে শুনতে হবে মন্ত্রী নাই তো frustration এ ভুগছে।

কিছু অদ্ভুত মানসিকতাও দেখেছি। ধরুন-একজন সাবেক মন্ত্রী বা এম,পি যদি ব্যস্ত থাকার জন্য অথবা আর্থিক কারণে পরবর্তীতে চাকরী খোঁজেন (যদি তিনি ব্যবসায়ী না হন) -তখন তিরস্কার করে অনেকেই বলে-মন্ত্রী ছিলেন বা এম,পি ছিলেন, তখন আখের গোছাননি কেন? আশ্চর্য কথা। আমি তো জানি- আখের গেছানো মানে, পর কালের জন্য -নামাজ, রোযা , সৎকর্ম করে নেকি সংগ্রহ করা। এই নতুন আখের গোছানোর তাৎপর্য বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ।

এবার একজন নারীর জায়গা থেকে লিখছি। সবসময় social media তে দেখি কোন নারী, সে যেই হোক না কেন, এমন সব কথা বলা হয় তাকে নিয়ে, এমনসব comment করা হয়,এমন ভাবে নারীকে অপমান করা হয়, মনে হয় যে পুরো জাতি তার অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী। না জেনে, না শুনে,আপনার নেতিবাচক মন্তব্যে কারো তিলে তিলে গড়ে তোলা মর্যাদার পাহাড়ে চিড় ধরতে পারে। তাই জিহ্বা ও মন্তব্য সংযত রাখাই উত্তম।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতি করেছি। কেন্দ্রীয় যুবলীগের মহিলা সম্পাদিকা ছিলাম। সেই অধিকার থেকে বলি- শুধু মুজিব কোর্ট পরলেই কিন্বা বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে মুখে ফেনা তুললেই তাঁর আদর্শ ধারণ করা যায় না। আমি তাঁর আদর্শ ধারণ করেছি। সেই আদর্শ প্রয়োগ করেই আপোষহীন থেকেছি। আর যারা সে আদর্শ ধারণ করেনি- তাদের কাছেই আমি আজকের দিনে অপাংক্তেয়। তবু কস্ট নেই । আদর্শে, নীতিতে, সততায় যারা অবিচল তারা পরাজিত হয় না।

শেষ কথা হলো…লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেল কিন্তু সব বলা হলো কি? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-তিনি শোষিতের পক্ষে। সে সময় শোষক আর শোষিত এই দুইটি বিভাজনই ছিল শুধু। আজ এই দুই বিভাজনের মাঝে আরো সহস্র বর্ণিল বিভাজনে বিভাজিত আমরা। আমি উপলব্ধির বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত। অনেকেই ভাববেন-আমি চেতনার যুদ্ধে পরাজিত। ভুল। আমি ক্লান্ত ঠিকই, আমি পর্যুদস্ত ঠিকই। কিন্তু চেতনার যুদ্ধে জয়ী। তবে আমি এটাও জানি, এই চেতনা আর উপলব্ধি গুলো আঁকড়ে থাকলে, আজকের পৃথিবীতে এগিয়ে যাওয়া যায় না।

লেখক : এ্যাড.তারানা হালিম।
সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী –
সভাপতি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট।

Leave a Reply

Your email address will not be published.