শিগগিরই চূড়া থেকে নামছে করোনা

আন্তর্জাতিক জীবন-যাপন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার চার মাস পূর্ণ হল আজ। চতুর্থ মাসের শেষের দিকে করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গত কয়েকদিনে সংক্রমণ স্থিতিশীল রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের এ স্থিতিশীলতা আরও কিছুদিন চলতে পারে। এরপর চূড়া থেকে নামতে শুরু করবে কোভিড-১৯। ঢাকায় ইতোমধ্যে সংক্রমণ কমছে। তবে আগামী কোরবানির ঈদ আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টা কীভাবে সামাল দেয়া হবে তার ওপর সংক্রমণ কমা বা বাড়ার প্রবণতা অনেকটা নির্ভর করবে।

সর্বশেষ পাঁচ দিনের কোভিড-১৯ শনাক্তের পরিসংখ্যান তুলে ধরে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস ট্র্যাকার বলছে, বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। ৬ জুলাই তাদের ট্র্যাকার অনুযায়ী, বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার দুটিই নিম্নগামী হয়েছে।

দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চার মাসে করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৫ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ১৫১ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৭৮ হাজার ১০২ জন। এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮০টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রথম সংক্রমণের দেশ চীনে তিন মাসের মধ্যেই সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়াতেও নিচের দিকে নামতে শুরু করেছিল সংক্রমণের হার। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফোগ্রাফের তথ্যমতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার কমছে বাংলাদেশে। সংক্রমণের শীর্ষে থাকা বিশ্বের ২০টি দেশে সংক্রমণের প্রবণতা তুলে ধরেছে ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশে সংক্রমণের হার নিয়ে বলা হয়েছে, এই প্রবণতা এখন নিম্নমুখী। বাংলাদেশের পাশাপাশি নিম্নমুখী রাশিয়া, চিলি, যুক্তরাজ্য ও মিসরে। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, ইরান, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক, পাকিস্তান, বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ইকুয়েডর এবং আর্জেন্টিনায়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে করোনার প্রধান হটস্পট ঢাকাতে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোর পরিস্থিতিও কিছুটা উন্নতির দিকে। এদিকে ভাইরাসের রিপ্রডাকশন রেট-আর-নট (একজন সংক্রমণ রোগী কতজনকে সংক্রমিত করে সেটাকে আর-নট বলা হয়) গত দু’সপ্তাহে এই হার ১-এর নিচে নেমে এসেছে, যেটা একটা পজিটিভ সাইন। এটা আগে ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি এখন একজনের কম লোককে সংক্রমিত করছে। যা আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যবিদরা। এছাড়া গত কয়েকদিনে শনাক্তের সংখ্যাও আগের চেয়ে কমতির দিকে। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের আশপাশেই আছে শনাক্তের সংখ্যা।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ঢিলেঢালা লকডাউন, ঈদকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষের গ্রামে যাওয়া এবং শহরে ফিরে আসা, গার্মেন্টসহ দোকানপাট খুলে দেয়ার কারণে চতুর্থ মাসে সংক্রমণ বেড়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে করোনা সংক্রমণ স্থিতিশীল রয়েছে। শিগগিরই তা কমে আসবে। তবে এটা নিয়ে আমরা যেন আত্মতৃপ্তিতে না ভুগী। সংক্রমণ কমতে থাকলেও সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। জনসমাগম করা যাবে না। আসন্ন ঈদ ও কোরবানির পশুর হাটে সবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু সেটা করা না হলে ঈদুল আজহার সময় গরুর হাট এবং ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার প্রবণতা বাড়লে সংক্রমণের এই স্থিতাবস্থা আবার ঊর্ধ্বমুখীতে রূপ নিতে পারে। আমরা একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারি। তাই সবাইকে বলব, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে কোরবানি দিন। যে যেখানে আছেন ঈদের সময় সেখানেই থাকবেন।

তিনি বলেন, কোরবানির হাটে যারা গরু কিনতে যাবেন বা যারা গরু বিক্রি করবেন, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে একটা সমন্বয় করতে হবে। এজন্য অনলাইনে গরু কেনা বা হাটে না গিয়ে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যারা কোরবানির মাংস পৌঁছে দিতে পারেন, তাদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া যারা একাধিক পশু কোরবানি দেন তারা সেটা কমিয়ে সেই অর্থ গরিব অসহায়দের দিতে পারেন।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা স্বাস্থ্যবিদ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, করোনা শনাক্ত হওয়ার পর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাতে শিথিলতা ছিল। এ কারণেই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যার ফলে অবস্থার উন্নতি না হলেও ততটা অবনতি হয়নি। সরকারের নেয়া পদক্ষেপ যথাযথ বাস্তবায়ন এবং জনগণ আরও সচেতন হলে শিগগিরই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কমতে পারে।

তিনি বলেন, সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোরবানির হাট ও মানুষের বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টি। এ দুটি বিষয়কে শক্ত হাতে সামাল দেয়া সম্ভব না হলে আমরা ফের বিপদে পড়তে পারি।

বেশির ভাগ আক্রান্ত ও মৃত্যু চতুর্থ মাসে : দেশে চতুর্থ মাসে (জুন) ভয়াবহ রূপ নেয় করোনা। এ মাসে শনাক্ত, মৃত্যু, পরীক্ষা ও সুস্থ হওয়ায় রেকর্ড হয়েছিল। চতুর্থ মাসে শেষ মঙ্গলবার (৩০ জুন) পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগী ছিল এক লাখ ২ হাজার ৮৭৬ যা মোট আক্রান্তের ৬১ শতাংশ। মৃত্যুর হার ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে চতুর্থ মাসে। এ মাসেই সর্বাধিক ৮২ শতাংশ করোনা রোগী সুস্থ হয়েছে। নমুনা পরীক্ষাতেও হয়েছে রেকর্ড। চতুর্থ মাসে চার লাখ ৭৫ হাজার ৪৯৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে যা মোট পরীক্ষার ৫৪ শতাংশ। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমণের প্রথম মাসে রোগী শনাক্ত হয় ১৬৪ জন, মারা যায় ১৭ এবং সুস্থ হন ৩৩ জন। প্রথম মাসে (মার্চ) মোট ৪ হাজার ২৮৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় মাসে (এপ্রিল) রোগী শনাক্ত হয় ১২ হাজার ২৬১ জন, যা দুই মাসের মোট আক্রান্তের ৯৮ শতাংশ। দ্বিতীয় মাসে মৃত্যুবরণ করেন ১৮২ জন এবং সুস্থ হন এক হাজার ৮৭৭। দ্বিতীয় মাসে মোট মৃত্যু ও সুস্থ হওয়ার হার যথাক্রমে ৯১ ও ৯৮ শতাংশ। দ্বিতীয় মাসে বাড়ে পরীক্ষার হারও। এ মাসে মোট পরীক্ষা হয়েছে এক লাখ ১ হাজার ২২৪টি যা মোট পরীক্ষার ৯৬ শতাংশ। তৃতীয় মাসে (মে) আক্রান্ত হয়েছে মোট ৫৩ হাজার ৩৪৪ জন, যা মোট আক্রান্তের ৮১ ভাগ। তৃতীয় মাসে মোট মারা যায় ৬৮৯ জন যা মোট মৃত্যুর ৭৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ মাসে সুস্থ হয়েছেন ১১ হাজার ৯৯৩ যা মোট সুস্থের ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ। তৃতীয় মাসে বেড়েছিল পরীক্ষার হারও। এ মাসে নমুনা পরীক্ষা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৬৩ যা মোট পরীক্ষার ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ মুহূর্তে আক্রান্তের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশে সংক্রমণের পঞ্চম মাস শেষ হয়েছে। বাকি ৯টি দেশের পঞ্চম মাস চলছে। এর মধ্যে ১৩টি দেশে চতুর্থ মাসেও সংক্রমণরেখা ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেছে। কোনো কোনো দেশে পঞ্চম মাসেও সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ছয়টি দেশে তৃতীয় মাসের শেষদিক থেকে সংক্রমণ কমার প্রবণতা দেখা যায়। এর পাঁচটিই ইউরোপের স্পেন, ইতালি, জার্মানি, তুরস্ক ও ফ্রান্স। অন্যটি চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে চতুর্থ মাসেও ঊর্ধ্বগতি ছিল, ষষ্ঠ মাসে এসে তা কমতির দিকে। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এখনও সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.