বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলার রায়ে নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ৬ জনের মৃত্যুদন্ড এবং ৪ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন, রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আলকাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান এবং নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
খালাসপ্রাপ্তরা হলো, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর, কামরুল ইসলাম সাইমুন ও পলাতক আসামি মুসা বন্ড।
বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও অন্যান্য তথ্য উপাত্ত এবং আলামত বিশ্লেষন শেষে আজ এ রায় ঘোষনা করা হয়।
৪৩ কার্য দিবসের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে আজ এ রায় ঘোষণা করা হলো। এ রায়কে ঘিরে আজ বুধবার আদালত প্রাঙ্গনে এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
বুধবার সকালে বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের সঙ্গে নিহত রিফাতের স্ত্রী ও রিফাত হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি (আইনজীবীর হেয়াজতে থাকা) আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি আদালতে উপস্থিত হন। কারাগারে থাকা ৮ আসামীকে কঠোর প্রহরায় আদালতে হাজির করা হয়। রায়ের সময় মোট ৯ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলো। চার্জশিটভূক্ত অপর আসামি মুছাবন্ড পলাতক রয়েছে।
এ বছরের ১ জানুয়ারি বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ১০ আসামির বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ, হত্যার ষড়যন্ত্র এবং আসামিদের পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে চার্জ গঠন করেন। ৮ জানুয়ারি থেকে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মোট ৭৭ জনের মধ্যে ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি একজন সাক্ষি বিদেশে থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
কারাগারে থাকা আসামিরা হলো রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আলকাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন। আসামিদের মধ্যে পলাতক মুসা ব্যতীত বাকিরা রিফাত হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও বরগুনা জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ভূবন চন্দ্র হালদার জানান, ‘সাক্ষিদের জবানবন্দি থেকে শুরু করে সব ধরনের যুক্তিতর্ক ও প্রমাণাদির মাধ্যমে আমরা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি’।
বরগুনা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্র জানিয়েছে, আসামীদের মধ্যে {রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি (২৩), আলকাইউম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯), মো. মুসাবন্ড (২২), আয়শাসিদ্দিকা মিন্নি (১৯), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯), ও কামরুল ইসলাম সাইমুন (২১)} এক নম্বর থেকে সাত নম্বর অভিযুক্ত সাত জনের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৪ ও ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এছাড়া ৮ ও ১০ নম্বর অভিযুক্তের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং আসামিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে ২১২ ও ১২০ বি ১ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়ছে। মামলার ৯ নম্বর আসামির বিরুদ্ধে আসামিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে ১২০ বি ১ ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ভাইরাল হয়।ভিডিওতে দেখা যায়, ধারালো দা দিয়ে রিফাতকে একের পর এক কোপ দিতে থাকেন দু’যুবক। ওই সময় রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি দু’যুবককে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। ঘটনাটি সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল নেয়ার পর রিফাত মারা যায় ।
এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদি হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এতে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষি করা হয়েছিল। এরপর আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও দেখে মিন্নির বাবার বিরুদ্ধেও মামলা করার কথা জানান রিফাতের বাবা। এরমধ্যে মামলার প্রধান সাক্ষি মিন্নিকে ১৬ জুলাই রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে স্বামী হত্যায় ফেঁসে যায় মিন্নি। পরদিন তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দ’ুদিন পরে মিন্নিকে আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। পরদিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। মিন্নির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী।
পরদিন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এসপির সংবাদ সম্মেলনের পরদিন বিকেলে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গত ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান মিন্নির জামিন নামঞ্জুর করেন। তার আগে ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালত মিন্নির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর মিন্নির জামিনের বিষয়টি হাইকোর্টে আসে। এ অবস্থায় মিন্নির জামিন কেন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে গত ২০ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ২৯ আগস্ট দু’শর্তে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট।
এরপর রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এক আসামির পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। সব আসামির পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। ১৬ সেপ্টেম্বর নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আদালতে উপস্থাপিত যুক্তিখন্ডন শেষে রায়ের এদিন ধার্য করেন আদালত।