হাতে লেখা মূল সংবিধানের লিপিকর একেএম আবদুর রউফের একান্ত সাক্ষাৎকার

অন্যান্য প্রচ্ছদ

হাতে লেখা মূল সংবিধানের লিপিকর একেএম আবদুর রউফের একান্ত সাক্ষাৎকার

[গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের হাতে লেখা মূল সংবিধানের লিপিকর জনাব একেএম আবদুর রউফ। বর্ণাঢ্য জীবনে অধিকারী প্রয়াত জনাব আবদুর রউফ ১৯৫৯-এ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। লন্ডন কলেজ অব প্রিন্টিং থেকে টাইপো-ডিজাইন ও গ্রাফিক ডিজাইন কোর্সে উত্তীর্ণ হন ১৯৭১-এ। এ বছরেই মহান মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে প্রবাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি ও মিশন থেকে ‍‍”বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা” নামে অর্ধ সাপ্তাহিক প্রত্রিকা নিজ হাতে লেখা ও সম্পাদনা করে ৫,০০০ কপি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিতরণ করতেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরম স্নেহাস্পদ ছাত্র জনাব রউফ আমৃত্যু একজন কর্মবীর ছিলেন। জাতির জনকের স্নেহধন্য এই মহান শিল্পী এখন আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু উত্তর প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন সারাজীবন ধরে করা অসংখ্য সৃজনশীল কর্মের নমুনা। তন্মধ্যে রয়েছে জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম হাতে লেখা সংবিধান। ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান দিবসে তাঁর পুণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছি। এবিষয়ে ১৯৯৯-এর ১০ই মার্চে নেওয়া তাঁর অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ পত্রস্থ করা হলো। সাক্ষাৎকার গ্রহণঃ- আবুল খায়ের।]

প্রশ্নঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানটি হাতে লিখিত হবে এবং আপনাকেই এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা করতে হবে এটা কীভাবে অবহিত হলেন?

উত্তরঃ ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু আমাকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদ টেলিফোন করলেন লন্ডনে। হাই কমিশনার সাহেব ও ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক আহমেদ চৌধুরী সাহেব আমাকে আর সময় দিলেন না। পারলে আকাশে পাখীর মতো উড়িয়ে দেন। তখন বিমান সপ্তাহে একবার সার্ভিস দিতো। হাই কমিশনার সাহেব ভারতীয় দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত শ্রী আপাপন্তকে বলে এয়ার ইন্ডিয়ায় একটা সিটের ব্যবস্থা করে আমাকে পরদিনই ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। আমি কেন ঢাকায় যাচ্ছি তার কিছুই জানি না। দিল্লী হয়ে ঢাকায় পৌঁছলাম সকাল ১০টার দিকে। দেখি প্লেনের কাছে গাড়ী নিয়ে জনাব মহিউদ্দীন সাহেব (ইনি মুক্তিযুদ্ধের সময় হংকং থেকে ডিফেক্ট করেছিলেন এবং তখন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক) উপস্থিত। তিনি আমাকে বর্তমান গণভবনের ওখানে সরকারী রেস্ট হাউসে নিয়ে এলেন। বললেন- আপনি গোসল সেরে খেয়ে নিন। আমি আসছি আপনাকে নিয়ে যাবো। আমি জিজ্ঞেস করলাম- আমাকে কেন ঢাকায় আনা হয়েছে এবং কতদিন থাকতে হবে? তিনি কিছুই জানেন না, বললেন। তবে এটুকু জানাতে পারলেন যে, খাওয়ার পর এসে তিনি আমাকে ডঃ কামাল হোসেন সাহেবের বাসায় নিয়ে যাবেন।
সাড়ে তিনটার দিকে আমরা মিন্টো রোডে আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন সাহেবের বাসায় গেলাম। তিনিও তাড়াহুড়ো করে গণভবনে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমার বন্ধু রফিকউল্লাহর সাথে দেখা হলো। সে বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারী। বললো একটু বসতে হবে। বাইরে তখন আরো অনেক লোক। আমরা চা খেয়ে বসে কথা বলছি তার একটু পরেই বঙ্গবন্ধু এলেন। রফিকউল্লাহ আমাদের ডেকে নিলো। বঙ্গবন্ধুর নিকট যাবার সময় আমার বুক দুরু দুরু করছিলো। কিন্তু না, কিছুই না। বঙ্গবন্ধু পরমাদরে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন- তোকে কেন আসতে বলেছি জানিস? আমি তখনও পরিষ্কারভাবে কিছুই জানতে পারিনি। শুধু মন্ত্রী সাহেব একবার একটু বলেছিলেন কিছু লেখালেখির কাজ আছে। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার করে বললেন- তোকে ঢাকায় এনেছি বাংলাদেশের সংবিধান হাতে লিখে দেওয়ার জন্য।

প্রশ্নঃ সংবিধান লেখার কাজে সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত হলো কীভাবে? একাজে অন্যান্য সহযোগী যাঁরা ছিলেন অর্থাৎ এটাতো একটা টিম ওয়ার্ক ছিল- সে সম্পর্কে কিছু বলবেন।

উত্তরঃ আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে। নাশতাসহ খাওয়া-দাওয়ার সবকিছু ব্যবস্থাও সেখানে করা হয়েছে। দু’দিন পর জয়নুল আবেদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো। স্যার সব বললেন। সংবিধানের মতো এরকম গুরুত্বপূর্ণ দলিলটির অঙ্গসজ্জা করবেন অন্যান্য শিল্পীবৃন্দ আর সম্পূর্ণ টেক্সট হাতে লিখতে হবে আমাকে। স্যার নিজেও প্রত্যেক পরিচ্ছেদ শেষে একটা করে স্কেচ করে দেবেন। তখনকার গণপরিষদ তথা সংসদ ভবন ছিল বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সংসদ সচিবালয়ের সচিব ছিলেন জনাব রহমান, উপ-সচিব ছিলেন খন্দকার আবদুল হক, সহকারী সচিব ছিলেন কাজী শামসুজ্জামান। সংসদ ভবনের একদিকে আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের রুম ছিল। তিনি সেখানে বসে দিন-রাত কাজ করতেন। কাজ হচ্ছে নতুন সংবিধানের খসড়া রচনা করা। ডঃ আনিসুজ্জামান প্রায় সর্বক্ষণ সেখানে থেকে তাঁকে সাহায্য করতেন। সুসাহিত্যিক নেয়ামাল বাসিরও প্রায় সর্বক্ষণ থাকতেন। নেয়ামাল বাসির ও ডঃ আনিসুজ্জামান যখন জগন্নাথ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে ছিলেন তখন আমি ছিলাম প্রথম বর্ষে। আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখানে তাদের সাথে দেখা হওয়ার পর আমি আরো উৎসাহিত হলাম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কয়েকটি সংবিধান সেখানে দেখলাম। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে এবং দেশের সকল বিধানের প্রতি দৃষ্টি রেখে খসড়া সংবিধান তৈরী শুরু হয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, লণ্ডভণ্ড, সমস্যায় জর্জরিত আপামর জনসাধারণকে নিয়ে সকলেই ব্যস্ত- এর মধ্যে এতো স্বল্প সময়ে দেশকে একটি অতি প্রয়োজনীয় সংবিধান উপহার দেওয়া সত্যিই আশ্চর্যজনক দুরূহ বিষয়। দেখা হলো শিল্পী হাশেম খানের সঙ্গে। হাশেম খান আমার স্নেহাস্পদ, ছোট ভাইয়ের মতো। হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, আবুল বারক আলভী আর সমরজিৎ রায় চৌধুরী একত্রে অঙ্গসজ্জার কাজ করবেন। বঙ্গবন্ধু সংসদ সচিবালয়ের সচিব রহমান সাহেবকে তাঁর রুম (এয়ারকন্ডিশন থাকায়) ছেড়ে অন্য রুমে বসার জন্য বলে দিলেন এবং আমাদের ঐ রুমে বসে কাজ শুরু করতে বললেন।

ডঃ কামাল হোসেন সাহেব আমাকে বললেন- কাগজ, কালি বা যা যা লাগবে তার ব্যবস্থা করার জন্য সচিবালয়ের উপসচিব আবদুল হককে বলে দিয়েছেন। তিনি সংবিধান লেখার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর এক আলোচনা ও চা-চক্রের আয়োজন করলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু আমার কাঁধে একহাত ও অপর হাত তখনকার মহিলা এমএলএ রাফিয়া আখতার ডলির কাঁধে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সকলের নিকট আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

প্রশ্নঃ পুরো সংবিধানটি হাতে লেখার মতো একটি দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে কীভাবে এগুলেন অর্থাৎ আপনার পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করলেন?

উত্তরঃ আমি লেখা কীভাবে শুরু করবো তা অনেক চিন্তা করে ভাগ করে নিলাম। প্রত্যেক পরিচ্ছেদের জন্য একরকম, প্রত্যেক ভাগের জন্য একরকম, সূচীপত্রের জন্য একরকম, নম্বরের জন্য একরকম, অনুপংক্তির জন্য একরকম আর সমস্ত লেখার জন্য একরকম লেখা হবে। সাদা কাগজে খসড়া করলাম। নিজে প্রয়োজনমত হিসেব করে লাইন টানলাম, স্পেসের লাইন ঠিক করলাম। তিন পৃষ্ঠা লেখার পর ডঃ কামাল হোসেন, ডঃ আনিসুজ্জামান ও স্যারকে দেখালাম। সকলেই প্রশংসা করলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু দেখলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন- আমি জানতাম রউফ ভালো করবে। খুব ভালো হয়েছে। দেখলাম, স্যার (জয়নুল আবেদিন) আমার থেকেও খুশী হয়েছেন।

লিখতে শুরু করে যে বিপদে পড়লাম সেটা হলো- হয়তো একটা পৃষ্ঠা প্রায় শেষ অথবা মাঝামাঝি অথবা পুরোটা হয়েছে কিন্তু তখন দেখা গেল একটা বানান ভুল। সংবিধানে ভুল থাকতে পারবে না। ডঃ আনিসুজ্জামান ও নেয়ামাল বাসির খুঁজে খুঁজে ভুল বের করে আমাকে বার বার বিপদে ফেলেছেন। এমনও হয়েছে কোন কোন পৃষ্ঠা দুবার তিনবারও লিখতে হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আমার লেখার কাজ শেষ। তখন আমিও বসে গেলাম অঙ্গসজ্জার জন্য বর্ডার ডিজাইন করতে। আমি যেহেতু এখানেই থাকি তাই সময় কাটাবার জন্য ইচ্ছা করেই সেখানে কাজে থাকতাম। অন্য শিল্পীরা তাদের স্ব-স্ব বাসায় থাকতেন।

প্রশ্নঃ আমরা দেখেছি, ৭২-এর সংবিধানের মূল অংশ ৭২ পাতায় শেষ করা হয়েছে। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?

উত্তরঃ দেখুন, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে আমার যারা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি- তাদের স্বপ্ন ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি অপরূপ সুন্দর দেশ গড়ে তোলার। সংবিধান হাতে লেখার দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মাথায় যে চিন্তাটি ঘুরপাক খেতে থাকে তা হচ্ছে, কীভাবে একাজে বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু দিক আরোপ করা যায়। যা সংবিধানটিকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে আরও বিস্ময়, মযাদাপূর্ণ আকর্ষণীয় করে তুলবে। এব্যাপারে সংবিধান যেদিন গৃহীত হয়, অর্থাৎ ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৭২ সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লক্ষ্য করবেন তিনিও বলেছেন, ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা। আর আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন স্যার, যাঁর কাছে আমি আমার শিল্পীসত্ত্বা অর্জনের দীক্ষা পেয়েছিলাম- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, তিনি আমাকে এ-ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উৎসাহিত করেছেন। ৭২-এর সংবিধান ৭২ পাতায় শেষ করতে হবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি প্রথমেই গণনা করে ফেলি সর্বমোট কতগুলো অক্ষর রয়েছে সংবিধানে। এরপর কাগজের সাইজ ঠিক করে নেই। লেখার এরিয়া, লেখার এরিয়াকে গ্রাফশীটে এঁকে প্রতিটি অক্ষরের একটা সাইজ হিসাব করে বের করে নেই। এরপর অক্ষরগুলোকে ঠিক করা সাইজে বণ্টিত করে করে ৭২ পৃষ্ঠার মধ্যে ১৫৩টি অনুচ্ছেদের লিপিবদ্ধ বিধানসমূহকে বণ্টন করে লেখায় হাত দেই।

প্রশ্নঃ মূল হাতে লেখা সংবিধানে ৩৯৯ জন গণপরিষদ সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে। স্বাক্ষর-দান অনুষ্ঠানে কী আপনি উপস্থিত ছিলেন? সেই অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

উত্তরঃ তখন সংসদ অধিবেশন চলছিল। ১৩ই ডিসেম্বর সংসদস্থ বঙ্গবন্ধুর খাস কামরায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও ডঃ কামাল হোসেন সাহেব এই হাতে লেখা সংবিধানের কপিটি বঙ্গবন্ধুকে দেখালেন। আমাকে স্যার সঙ্গে নিয়ে গেলেন এবং অন্য শিল্পীদেরও সেখানে উপস্থিত থাকতে বললেন। বঙ্গবন্ধু ভালো করে প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখে বললেন, সংসদে যেসব সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান এসেছে তাদেরকে ডাকো, এটা দেখাও, সকলেই দেখুক। পরদিন সকালে প্রায় প্রত্যেকটি প্রত্রিকায় সংবিধানের কপিসহ আমাদের গ্রুপছবি ছাপা হলো। ১৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন। সেখানে তখন বহু সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আজ ও আগামীকাল গণপরিষদে হাতে লেখা সংবিধানে পরিষদ সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর করবে এবং ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিন থেকে সংবিধান বলবৎ হবে। তুই সেখানে থাকবি। সকল সদস্যের স্বাক্ষর নিতে হবে। স্বাক্ষর হবে বাংলায়। সংবিধানের ইংরেজী করা হয়েছে। সেটি প্রেসে ছাপা হচ্ছে। হাশেম খান ইংরেজী কপি ছাপার ব্যবস্থা করেছে। ঠিক হলো ইংরেজী কপির জন্য একই সাথে ইংরেজী স্বাক্ষর নিতে হবে।

পরদিন সকালে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে। আমার পৌঁছতে একটু বিলম্ব হয়েছে। গেটের কাছে গেলে আমাকে আটকানো হলো। সদস্য ছাড়া আর কারও এই দরজা দিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। কিছু দূরে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার নাম ও আসার কারণ জানতে চাইলেন। আমি পরিচয় দিতেই তিনি ইশারা করলেন, দরজা খুলে দিতে। আর আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে স্পীকার সাহেবের কাছে আমার আসার কথা বলতেই তিনি ঘোষণা করলেন সংবিধানের লিপিকর জনাব আবদুর রউফ এসেছেন। আমাদের আলোচনা ও ভোট গ্রহণের পর সদস্যগণ স্বাক্ষর-দান করবেন। আমি আপনাদের নাম ধরে ডাকবো। পরিষদের অধিবেশন পূর্ব থেকেই চলছিল। আজই শেষ দিন। তবুও আলোচনা হচ্ছে। স্পীকার সাহেব আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন- আপনার সব ঠিক আছে তো? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

এরপর স্পীকার সাহেব এক একজন সদস্যের নাম ধরে ডাকলেন- প্রথমেই শেখ মুজিবুর রহমান, সদস্য। বঙ্গবন্ধু উঠে আমার সামনে এলেন। আমি কাগজ-কলম তাঁর হাতে দিলাম। তিনি সামনের চেয়ারে বসে স্বাক্ষর করলেন বাংলায়, শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর জ্যেষ্ঠতানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সদস্য, তাজউদ্দীন আহমেদ, সদস্য এইভাবে একে একে সকল সদস্য এলেন আর আমি তাঁদের স্বাক্ষর গ্রহণ করলাম। পাশাপাশি হাশেম খান ইংরেজী স্বাক্ষর গ্রহণ করলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এইভাবে তৈরী হলো।

প্রশ্নঃ যতদূর জানা যায়, হাতে লেখা মূল সংবিধানটির বেশকিছু কপি মুদ্রণ করা হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কীভাবে সেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল, সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

উত্তরঃ এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, এর কিছু কপি দরকার। কপিতো নেই। একটাই মাত্র তৈরী হয়েছে। তবে এর থেকে অফসেট প্রিন্ট বের করা যেতে পারে। সে সময় ঢাকাতে অফসেট প্রিন্ট হতো মাত্র তিন কি চারটি প্রেসে। সাবধানতার কারণে সরকারী প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা সম্ভব কিনা খোঁজ নিতে বললেন। তখন গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন জনাব সিদ্দিকুর রহমান। আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম। তিনিও লন্ডন কলেজ অব প্রিন্টিং থেকে প্রিন্টিং সম্পর্কে কোর্স করতে গিয়েছিলেন, সেই সূত্রে তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি জানালেন- তাদের ওখানে একটা অফসেট মেশিন এসেছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে আর ব্যবহার করা হয়নি। তিনি নির্দেশ পেয়ে তার লোকজন লাগিয়ে প্রুফ তুললেন। এসময় হাশেম খান খুব পরিশ্রম করেছে। ছাপার কাজ চললো। স্যার প্রত্যহ দেখতেন কতদূর এগিয়েছে। প্রত্যেক পরিচ্ছেদ শেষে স্যারের মূল্যবান স্কেচ থাকায় সংবিধানের মর্যাদা আরও বেড়েছে। পরিচ্ছেদের শুরুতেই এক একজন শিল্পীর আঁকা বর্ডার ডিজাইন ছাপা হলো। শেষ দিকে স্যার নিজের সংগ্রহ থেকে তাঁর মায়ের ব্যবহৃত একটা নকশি কাঁথা নিয়ে এলেন। এতো সুন্দর জিনিষটির রি-প্রোডাকশন স্যারের পছন্দমত ভেতরে পুস্তানীতে দেওয়া হলো। পুস্তানীটি ছাপা হলো ইস্টার্ন রিগাল প্রেসে। সবশেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হলো আমরা যাঁরা এই মহতী কর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম তাদের সকলের নাম।

হাতে লেখা মূল সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আপনার দুর্লভ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্মৃতি তর্পণ করায় আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

আপনাদেরও ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.