প্রিয়দর্শিনী’র প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি!

অন্যান্য প্রচ্ছদ


আবুল খায়ের : প্রকাশক ও সম্পাদক – মেঘদূত

যে “ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে, আমি ভুলিবো না, আমি কভু ভুলিবো না”

নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদানে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলেন মহীয়সী নারী প্রিয়দর্শিনী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী! দেরীতে হলেও ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় অভিষিক্ত করেছে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে সম্মত করাতে তাঁর অবদান ইতিহাসে রত্নখচিত হয়ে আছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অন্তিমলগ্নে ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিতে ভারত আক্রমণ করে তখন থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি দিনই ছিল সুকঠিন।

সেই সময়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা এবং অসামান্য কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। ১৯৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোতে ভারত সরকার ও লোকসভার সিদ্ধান্ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি এবং ভ্রাতৃপ্রতীম ভারতের জনসাধারণ কর্তৃক দেশরক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন এসবই এখন ইতিহাসের অংশ। কী ঘটেছিল সেই দিনগুলোতে-

১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী গেরিলা আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে উপায়ন্তর না দেখে দিশেহারা হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বাঙালীর বিজয় যখন আসন্ন, পক্ষান্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ের গ্লানি এড়াতে পাকিস্তান সরকার বিনা উস্কানীতে সরাসরি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। এই আক্রমণের নেপথ্য-কৌশল ছিল, ভারতের কাছে পরাজিত হলে যুদ্ধরত পাকিস্তানী সৈন্যরা জেনেভা কনভেনশনের সুযোগ লাভ করবে, সর্বোপরি ভারত সরাসরি এ যুদ্ধে জড়ালে যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদে জাতিসংঘ এগিয়ে আসবে,- তাতে হয়তো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ঐক্য অটুট রাখা সম্ভবপর হবে। এসকল বদ চিন্তা-ভাবনা তথা কলা-কৌশল মাথায় রেখে ওইদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনী আকস্মিকভাবে পশ্চিম ভারতের বিমান ঘাঁটিগুলো তথা শ্রীনগর, অবন্তীপুর, অমৃতসর, ফিরোজপুর, চণ্ডীগড়, ফরিদকোট, পাঠানকোট, সাদেক, ওকহা, জোধপুর ও উত্তরলাই, আম্বালা, এমনকি দিল্লীর সন্নিকটে আগ্রার বিমানক্ষেত্র এবং পূর্ব ফ্রন্টের আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ চালায়। এসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় গড়ের মাঠে বক্তৃতারত অবস্থায় পাকিস্তান কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সংবাদটি অবহিত হন। সভা-সফর স্থগিত করে কালবিলম্ব না করে তাঁর ভাষণ সংক্ষিপ্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পরমহিতৈষী শ্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে সঙ্গে নিয়ে ওইদিনই রাত ১০-৩০ মিনিটে দিল্লী ফিরে তিনি রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও উর্ধতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করেন। অতঃপর রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সঙ্কটজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাত ১২-২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক বেতার ভাষণে বলেন, “শত্রুরা আমাদের বিমানক্ষেত্রসহ সীমান্ত সন্নিহিত সবগুলো প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়েছে। এরকম সমূহ বিপদের মধ্যেও ভারত যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। বিগত মার্চ মাস থেকেই আমরা একটা ব্যাপক বিপদগ্রস্ত (পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাদের দোষ ছিল যে, তারা গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তাদের সমস্যা আমাদের ছুঁয়েছে, ভাবিয়েছেও বটে। চেষ্টা করেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বিশ্ব সভা মূল সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে বাইরের দিকটা সামান্য আলোচনায় এনেছে মাত্র। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অসীম সাহসী শৌর্যবান মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছে দেশপ্রেমের উন্মাদনায়। আমরা তাদের সম্মান করি। আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করলো। এর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর, আমার সরকারের ওপর এবং সর্বোপরি ভারতের সমস্ত জনগণের ওপর। যুদ্ধের তাণ্ডব থেকে আমাদের আর পেছনে ফেরার কোন উপায় নেই। আমাদের দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী যোদ্ধা জওয়ানরা দেশের প্রতিরক্ষার জন্য এগিয়ে চলেছে। সারা ভারতে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরী অবস্থা এবং এর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।”

বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট প্রদান এবং জীবনবাজি রেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এ যুদ্ধকে ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেন। এমন সহমর্মী সমবেদনা প্রকাশ এবং অপর দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিজ দেশের স্কন্ধে তুলে নেয়ার মহত্ত্ব সচরাচর দৃষ্ট নয়। কেবলমাত্র আদর্শিক ও নৈতিক বন্ধনই পারে এরূপভাবে একাত্ম হতে। প্রদত্ত ভাষণে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেন, “বিপদগ্রস্ত (পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি” এবং “তাদের সমস্যা আমাদের ছুঁয়েছে, ভাবিয়েছেও বটে। চেষ্টা করেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের”- এ কথাটি নিছক কথার কথা নয়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সারা বিশ্ব ঘুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলেছিলেন।

এর পরদিন অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যৌথ দস্তখতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পত্র প্রেরণ করা হয়। ওই পত্রের মূল বক্তব্য ছিল, “আমরা গভীর বেদনার সাথে লক্ষ্য করছি, গত ৩ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নে পাকিস্তান সামরিক জান্তা কাপুরুষোচিতভাবে আপনার দেশ আক্রমণ করেছে। এহিয়া খানের সর্বশেষ এই অপরিণামদর্শী অপকর্ম সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির লঙ্ঘন যা চূড়ান্তভাবে এটাই প্রমাণ করে যে, তার লক্ষ্য হচ্ছে উপমহাদেশের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে স্নায়ুবিক চাপ, ধ্বংস এবং আর্থসামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করা। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের এবংবিধ নগ্ন অভিলাষ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ সচেতন এবং ৯ মাসের কিছু আগেই তারা এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সূচনা করেছিল।

ইতোপূর্বে ১৫ অক্টোবর এবং ২৩ নবেম্বর পাকিস্তান সামরিক জান্তার সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছিলাম যতক্ষণ না পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দখলদার বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ পরাজয় সুনিশ্চিত হচ্ছে ততক্ষণ লক্ষ্য পূরণে আমরা অবিচল থাকব। আপনার দেশের ওপর এহিয়া এবং তদীয় দোসর জেনারেলগণ কর্তৃক সম্পাদিত আগ্রাসন মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগ্রাসীদের বিতাড়নে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে সযত্নে লালিত আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও সাধারণ মূল্যবোধ অনুযায়ী চালিত হবে। ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ আপনার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কর্তৃক সম্পাদিত নগ্ন আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী যে কোন সেক্টরে বা যে কোন ফ্রন্টে যুদ্ধে সদা প্রস্তুত।”

বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষণটি ভারত সরকারের কর্মে শুরু থেকেই প্রতিফলিত। ১৯৭১-এর মার্চের ২৫ তারিখ রাত ১১-৩০ মিনিটে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার নীলনকশানুযায়ী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার। আর সেই আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কালবিলম্ব করেননি বরং গণহত্যা শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই পূর্ব প্রস্তুতি মোতাবেক সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পরমাকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেছিলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন …!” জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার মুখনিঃসৃত এই আমোঘ বাণী নব উদ্ভূত “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের” রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের নৈতিক ভিত্তি যুগিয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক বৈধতা।

স্বাধীনতা ঘোষণার এই নিয়মানুগ বৈধতার বলে বলীয়ান হয়ে নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবে মুক্তিযুদ্ধের পরম মিত্র ভারতবর্ষের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মার্চের ৩১ তারিখে অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে এটা তুলে ধরা যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ন্যায্য ও বৈধ। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল-

“(১) পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে এই সভা গভীর উদ্বেগ ও সমবেদনা প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ দমন করবার উদ্দেশে তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান হতে আমদানি করা সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ করা হয়েছে। (২) ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় নির্বাচনে সেখানকার জনগণ যে অভ্রান্ত রায় দিয়েছে, তাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার জনগণের সেই নির্ভুল অভিমতকে অগ্রাহ্য করার পথ বেছে নিয়েছে। (৩) পাকিস্তান সরকার আইনসম্মত উপায়ে জনগণের প্রতিনিধিবৃন্দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে কেবলমাত্র অস্বীকার করেন নাই, বরং জাতীয় পরিষদকে তার ন্যায়সঙ্গত তথা সার্বভৌম অধিকার গ্রহণে অন্যায়ভাবে বাধা দিয়েছেন। বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, বিমান বহর ও ভারি গোলাগুলি প্রভৃতি দিয়ে বর্বরোচিত নগ্ন আক্রমণের দ্বারা পূর্ববঙ্গের জনগণকে অবদমিত করার চেষ্টা চলছে। (৪) ভারতীয় জনসাধারণ এবং সরকার সর্বদাই পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা করছে। ভারতের অবস্থান এবং এই উপমহাদেশের জনগণের শতাব্দীব্যাপী ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগত বন্ধনের দৃষ্টিতে এই সভা আমাদের সীমান্তের এত সন্নিকটে অনুষ্ঠিত জঘন্য অত্যাচারের প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। একটি নিরস্ত্র এবং নির্দোষ জনগণের উপর এরূপ এক অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের সর্বত্র জনগণ নিঃসংশয়ে ধিক্কার দিয়েছে। (৫) পূর্ববঙ্গের জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনধারণের এই সংগ্রামের প্রতি এই সভা গভীর সমবেদনা ও সংহতি জ্ঞাপন করছে। (৬) শান্তি এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতি ভারতের যে চিরস্থায়ী আগ্রহ রয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই সভা অবিলম্বে সকল প্রকার শক্তির প্রয়োগ ও নিরস্ত্র জনতার নির্বিচার হত্যা বন্ধের জন্য দাবি জানাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার কাজকে, যা গণহত্যার সমতুল্য, অবিলম্বে বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই সভা বিশ্বের সকল সরকারের এবং জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। (৭) এই সভা গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করছে যে, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি জনগণের এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান জয়যুক্ত হবে। এই সভা এই আশ্বাস দিচ্ছে যে, ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমবেদনা তাঁরা তাঁদের এই ত্যাগ ও সংগ্রামের পিছনে লাভ করবেন।”

বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে ভারতীয় লোকসভার যুক্ত অধিবেশনে প্রদত্ত ঐতিহাসিক বক্তৃতায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত হবে। এই সভা নিশ্চয়ই চায় যে, আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁদের অন্যান্য সহকর্মীদের নিকট আমাদের ঐকান্তিক সংবর্ধনা ও আন্তরিক অভিনন্দন পৌঁছে দেই। … বাংলাদেশের জনগণ বিরাট বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। … বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার এবং জনগণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য যে একসাথে কাজ করেছে তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। …একমাত্র এরূপ একটি নীতিই এতদঞ্চলে শান্তি, স্থায়িত্ব ও প্রগতির পথ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। …বাংলাদেশ সরকার ভারতে আগত শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের এবং তাদের জমি-জমা ও জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য পুনরায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। ভারত স্বাভাবিকভাবেই এই প্রচেষ্টা কার্যকর করার ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।”

লোকসভার সকল সদস্যবৃন্দ দাঁড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাকে অভিনন্দন জানান। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুরু থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত ভারত সরকার ও জনসাধারণ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দীর্ঘ ২৬ বছরের সেনা শাসনে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার জোড়কলম বানাবার হীন ও ষাড়যন্ত্রিক অপচেষ্টায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ভূলুন্ঠিত করবার নিরন্তর চেষ্টা হয়েছিল। তথাপি সেনাশাসক ও রাজাকারেরা সে চেষ্টায় সফলকাম হতে পারেনি। যুদ্ধোত্তর কালে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পক্ষে ভারতবর্ষ ও ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকাকে আমরা যতই প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালাই না কেন তা ধোপে টিকেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি তার বিপুল দরিদ্র জনসাধারণের ভার বহনে অক্ষম হয়েও নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদানে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিল; পরম শ্রদ্ধা আর বিনম্রচিত্তে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তা রত্নখচিত হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৩,৬৩০ জন ভারতীয় সৈনিক আত্মদান করে, ২৩০ জন নিখোঁজ এবং ৯,৮৫৬ জন সৈনিক আহত হয়। ভিন জাতির এসব বীর সৈনিকদের সুমহান ত্যাগের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা না জানিয়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের স্মরণ না করে ইতোমধ্যে অকৃতজ্ঞতার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আমরা যথেষ্ট স্থাপন করেছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মহিয়সী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করবার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিঃসন্দেহে এই মহতী উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বিগত দিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.