ড. মুহম্মদ মনিরুল হক :: মুজিববাদ একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন ও মূল্যবোধের সমষ্টি, যার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে সুখী-সমৃদ্ধ, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার কথা। মুজিববাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘সোনার বাংলা’ কায়েম করা। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুজিববাদের চার স্তম্ভ।
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুজিববাদের চার স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ জাতীয় সংসদে সংবিধান (গৃহীত) বিল অধিবেশনের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিববাদের চার মূলনীতির প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট করেছেন।
মুজিববাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফায়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা জনসাধারণের মুক্তির সনদ। বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি ‘ছয় দফা’ শোষকের হাত থেকে শোষিতের অধিকার ছিনিয়ে আনারও হাতিয়ার। ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আগে ‘স্লোগান ছিল ছয় দফা, এখন চারটি স্তম্ভ।’ সচেতন ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন ভাষা আন্দোলনের পর ছয় দফা আন্দোলনই ছিল পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালির প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন, যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন পূর্ববাংলার মেহনতি জনগণ ও শ্রমিক সমাজ।
ছয় দফার অন্যতম দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনের পূর্বদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করলে সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। পরের দিন পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় ছয় দফা সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবেও চিত্রিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। জনমত আদায় ও আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসাবে ‘আমাদের বাঁচার দাবি-ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকাও প্রণীত হয়।
শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এ আন্দোলনের একনিষ্ঠ ও সফল সংগঠক। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় ও সফল করতে তিনি রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। ‘ছেষট্টির সাত জুন-প্রস্তুতি পর্ব’ নিবন্ধ পাঠে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরও কিছু সংগঠনের আপত্তি থাকায় ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায় এবং হরতাল সফল করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ৭ জুন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে শেখ মণি লিখেছেন, ‘…জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কী হলো সেটি সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরতাল হবেই।’ ‘মানিক মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, ইত্তেফাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তিনি সবকিছু করবেন।’
৭ জুনের হরতালকে সফল করতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের সংগঠিত করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ওই হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ কমপক্ষে ১১ জন বাঙালি শহিদ হয়েছেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, ৭ জুনের হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। ছয় দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে শেখ মণির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা করা হয়েছিল। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হলেও শেখ মণিকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ছয় দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। …আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সবার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।’
ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনের ইশতেহার ও কর্মসূচিতে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের অন্যতম কারিগরও বলা হয় শেখ মণিকে। একাত্তরের ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর কী করতে হবে এ চিন্তায় সবাই যখন দিশেহারা, তখন প্রেরণার বাতিঘর হয়ে জাতির সামনে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন শেখ মণি। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী হিসাবে তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মুজিববাহিনী। মুজিববাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; যা মুজিববাদের অন্যতম লক্ষ্য। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার এবং মুজিববাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যুদ্ধও পরিচালনা করেছেন।
একাধারে লেখক, গল্পকার, তাত্ত্বিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি স্বাধীনতার পর মুজিববাদের আলোকে ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মুজিববাদকে পূর্ণাঙ্গ ও তত্ত্বীয় রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বারবার কলম ধরেছেন, আমলাতন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। ৬ অক্টোবর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমরা ধনতন্ত্রে ফিরে যেতে চাই না, আমরা চাই মুজিববাদী বাংলাদেশ। তাই মুজিববাদী বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য নতুন আইনের শাসন দরকার, পুরোনো আইনের ব্যাধির সংক্রমণ নয়। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার চাহিদা সেটাই।’ ‘মুজিববাদ দর্শনে ও বাস্তবে’, ‘বিজয় আমাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়নি অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছে’, ‘আমলার কেরামতি’, ‘মোনেমের আমলা দিয়ে মুজিবের শাসন চলবে কি’, ‘কোন নেপোরা দই খাচ্ছে’, ‘হঠাৎ ভাগ্য পরিবর্তন’, ‘বন্ধু সাচ্চা ও দো-আঁশলা’, ‘বঙ্গবন্ধু ঘোর দুর্দিনে পথ দেখাইবেন’ শিরোনামের নিবন্ধগুলোতে তিনি ক্ষমতাচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্তদের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে মুজিববাদী মতবাদের আলোকে সমাধান ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। সে কারণে তিনি অনেক ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজনও হয়েছেন।
১৩ মার্চ ১৯৭৩ এক নিবন্ধে শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, ‘এ সংগ্রাম অতি দুস্তর, মুজিববাদ কায়েমের সংগ্রাম অতি কঠোর সংগ্রাম।’ সেই কঠোর সংগ্রামেই আজীবন আপসহীন ছিলেন তিনি। ‘সোনার বাংলা’ তৈরির মৌলিক পথ মুজিববাদ, বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ও শেখ ফজলুল হক মণিকে নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা হলে ‘সোনার মানুষ’ তৈরির পথ হবে সমৃদ্ধ, বাংলা-বাঙালির সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে আরও শানিত।
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক